গত ২০ জুলাই খুলনা পাবলিক কলেজের দেয়ালে গ্রাফিতিতে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীরা
জুলাই গণঅভ্যুত্থান শুধু এক রাজনৈতিক সংগ্রাম নয়–এটি এক সাংস্কৃতিক জাগরণও। তারই প্রকাশ ঘটেছে শিক্ষার্থীদের রংতুলি, দেয়াল আর স্লোগানে। ইতিহাসবিদরা যখন ২০২৪-এর দিকে তাকাবেন, তখন এ গ্রাফিতিগুলোই সাক্ষ্য দেবে– জনতার পক্ষে দেয়ালও কথা বলেছিল।সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান শুধু রাজনৈতিক বাস্তবতা বদলায়নি, জাগিয়ে তুলেছে এক সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ। ২০২৫ সালে তার বর্ষপূর্তিতে ‘২৪-এর রঙে গ্রাফিতি ও চিত্রাঙ্কন’ শিরোনামে দেশের শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন দেয়ালচিত্র কর্মসূচিতে। শহর থেকে গ্রাম, সমতল থেকে পার্বত্যাঞ্চল– দেয়াল হয়ে উঠেছে ইতিহাসের দলিল। দেয়ালজুড়ে আঁকা হচ্ছে আন্দোলনের দৃশ্য, শহীদের মুখচ্ছবি, ক্যালিগ্রাফি, প্রতীক, স্মৃতিচারণমূলক স্লোগান; যা একদিকে আবেগ ও আর্তি, অন্যদিকে ঐতিহাসিক দলিল। গ্রাফিতিতে উঠে এসেছে গণভবনে পতাকা উত্তোলন, শহীদদের শেষ মুহূর্ত, আন্দোলনের জনজোয়ার এবং অসংখ্য নাম না জানা তরুণ-তরুণীর আত্মত্যাগ। পটুয়াখালীর দুমকিতে সরকারি জনতা কলেজ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত গ্রাফিতি চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ১২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও তিনটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। যশোরের মনিরামপুরে উপজেলা পরিষদ চত্বরে চিত্রাঙ্কন এবং সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকার আয়োজন করে উপজেলা প্রশাসন। সেখানে অংশ নেয় বহু স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা।২০ জুলাই কুমিল্লা মহানগরীজুড়ে শিক্ষার্থীরা আঁকে শহীদদের ছবি, বিক্ষোভের স্লোগান এবং সময়ের দলিল হয়ে ওঠা বার্তা। এক শিক্ষার্থী জানায়, ‘আমরা ছবি আঁকছি যেন আমার ভাইবোনদের আর গুলি না খেতে হয়।’ এক গ্রাফিতিতে শহীদ আবু সাঈদের প্রসারিত দুই হাত– নিচে লেখা, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’।চাঁদপুরে ৪৮টি স্কুলের অংশগ্রহণে সীমানা প্রাচীরে আঁকা হয় আন্দোলনের নানা দৃশ্য। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে উপজেলা মাঠের দেয়ালে রংতুলিতে ফুটে ওঠে শহীদের রক্তাক্ত দেহ, প্রতিবাদী মুখ এবং গণদাবির স্লোগান।খাগড়াছড়ির ৯টি উপজেলার ৫৪টি স্কুলের শিক্ষার্থীরা দেয়ালে তুলে ধরেছে গণঅভ্যুত্থানের বিপ্লবী যোদ্ধাদের গ্রাফিক্স। পিরোজপুরে স্টেডিয়ামের দেয়ালে আঁকা হয়েছে গণতন্ত্র, অধিকার এবং ন্যায়বিচারের প্রতীক।দুই পর্যায়ের গ্রাফিতিজুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়কার গ্রাফিতি দুই পর্যায়ে আলাদা। সরকার পতনের আগে– প্রধানত সাদাকালো দেয়াল লিখন, স্লোগানভিত্তিক। সরকার পতনের পরে– রঙিন গ্রাফিতি ও চিত্রচর্চা, যেখানে শহীদের মুখ, স্মৃতি ও প্রতীক উঠে এসেছে।প্রথমদিকে ‘মেধা না কোটা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’–এসব চিত্রে বৈষম্যবিরোধী সুর থাকলেও, ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ মন্তব্যের পর দেয়ালগুলো হয়ে ওঠে ক্ষোভের ক্যানভাস। দেয়ালে লেখা হতে থাকে–‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘হামার ব্যাটাক মারলু কেনে?’, ‘লাশের ভিতর প্রাণ দে, নইলে গদি ছেড়ে দে’, ‘মাদার অব জেনোসাইড’, ‘স্টেপ ডাউন হাসিনা’–এই গ্রাফিতিগুলোর বেশির ভাগই শিক্ষার্থীদের হাতে আঁকা। কিছু অসম্পূর্ণ, কিছু অপরিষ্কার–তবু ভাষা স্পষ্ট, হৃদয় নিংড়ানো। এই দেয়ালচিত্রগুলো শুধু রাজনৈতিক সময়ের দলিল নয়–এরা হয়ে উঠে প্রতিবাদের শিল্প, আত্মত্যাগের ক্যানভাস।‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’–শহীদ আবু সাঈদের রক্তাক্ত শরীর, মুগ্ধের কণ্ঠে শেষ আর্তি ‘পানি লাগবে, পানি’, কিংবা হেলিকপ্টার দেখে বিস্মিত হয়ে নিহত এক শিশুর শেষ কথা– ‘বাবা, দেখো হেলিকপ্টার’ এসব স্মৃতি এখন জায়গা করে নিয়েছে দেশের হাজারো দেয়ালে, রংতুলি আর ব্রাশের আঁচড়ে।রাজধানীর উত্তরা, বনানী, ধানমন্ডি, মিরপুর, সায়েন্স ল্যাব, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুরসহ প্রায় সব এলাকায় আন্দোলনের আগে-পরে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই অর্থ জোগাড় করে দেয়াল রাঙায় প্রতিবাদের রঙে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দেন দেয়ালচিত্র কর্মসূচিতে। কারা আঁকে, কেন আঁকে?গ্রাফিতি শিল্পীদের পরিচয়ও প্রথাবিরুদ্ধ। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কেউ সাম্প্রতিক স্কুলপড়ুয়া, কেউবা বস্তির বাউন্ডুলে যুবক। কেউ পেইন্টিং জানেন, কেউ জানেন না– তাতে কী আসে যায়? তাদের কাছে দেয়াল কেবল ক্যানভাস নয়, প্রতিবাদের মাধ্যম।চট্টগ্রামের কোতোয়ালি এলাকার একটি দেয়ালে লেখা ছিল, ‘জান্নাতে লেখা হবে তোমার নাম, তুমি ছিলে আগুনের বন্ধু’–যা ছিল পুলিশের গুলিতে নিহত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নাঈমুল রাফির স্মরণে। জানা যায়, বন্ধুরা রাতে এসে লাল কালিতে এটি লিখে গিয়েছিলেন। পুলিশ পরে তা মুছে দেয়। পরবর্তী সময়ে আবারও তা লেখা হয়।এই গ্রাফিতিগুলোর বেশির ভাগই আঁকা হয়েছে অতি গোপনে, রাতের আঁধারে। কারণ রাষ্ট্রের চোখে এগুলো অপরাধ। অনেক জায়গায় এই দেয়ালচিত্র নির্মাণে বাধা দিয়েছে পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা, ধরা পড়েছেন কিছু তরুণ। তবু তারা থামেননি। তাদের ভাষায়– ‘শিল্পই আমাদের অস্ত্র। দেয়াল আমাদের ক্যানভাস। রাষ্ট্র আমাদের না শোনার ভান করলে আমরা তার শরীরেই লিখে দিই কথা।’ এ এক নির্মোহ সত্য–রাষ্ট্র যখন নিষ্ঠুর, তখন দেয়াল হয় দ্রোহের কণ্ঠস্বর।রাজনৈতিক প্রতিবাদের নতুন রূপএ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ইতিহাসে পোস্টার, লিফলেট, রোড শো, গান বা মিছিলে প্রতিবাদের প্রকাশ দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। তবে গ্রাফিতি বিশেষ করে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে একটি নতুন ধারার উত্থান হয়েছে। শুধু প্রতিবাদ নয়, এগুলো অনেক সময় স্মৃতিচিহ্নও। এগুলো দেখে থমকে যায় মানুষ, ছবি তোলে, শেয়ার করে। সামাজিক মাধ্যম হয়ে ওঠে একটি বিকল্প জাদুঘর, যেখানে এই দেয়ালচিত্র বেঁচে থাকে রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের ঊর্ধ্বে।সময়ের দলিল হয়ে উঠুক এই শিল্পআমাদের সংগ্রামের ইতিহাসে যেমন একদিন ছিল একুশে ফেব্রুয়ারির হাতে আঁকা ব্যানার, যেমন ছিল ’৬৯-এর হ্যান্ডবিল, তেমনি আজকের গ্রাফিতিগুলো হয়ে উঠছে আগামী দিনের ঐতিহাসিক দলিল। তরুণরা বলছেন–‘এই দেশটা আমাদের। ভয় পেয়ে নয়, ভালোবেসেই লিখি দেয়ালে। আমরা জানি, দেয়ালে একবার লেখা হলে, তা হৃদয়ে গেঁথে যায়।’ এই শিল্প, এই চিহ্ন–এ শুধু অভ্যুত্থানের নয়, বরং এক নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনারও আলামত।ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের একদল শিক্ষার্থী আঁকছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতীকী ছবি। শিক্ষার্থী আসফাক বলে, ‘এ রকম একটা দেশের স্বপ্ন আমরা দেখি। চাই বৈষম্যহীন সমাজ।’ঢাকা আর্ট কলেজের শিক্ষার্থী ফাতিমা এ লাবণী বলেন, ‘এখন মনে হচ্ছে, যা বলতে চেয়েছি তা রঙে বলতে পারছি। দেয়াল এখন আমাদের ডায়েরি।